মাগুরা প্রতিদিন : মাগুরার নাকোল রাইচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন সভাপতি উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হুমাউনুর রশীদ মুহিত এবং প্রাক্তন ও বর্তমান প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিদ্যালয় তহবিলের প্রায় চারকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
বিদ্যালয়ে নতুন এডহক কমিটির অভ্যন্তরিণ অডিট থেকে অর্থ তসরুপের বিষয়টি উঠে এসেছে।
জেলার শ্রীপুর উপজেলার নাকোলে ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টিতে গত বছরের ৭ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন এএসএম রফিকুল আলা। কিন্তু বিগত সময়ে বিদ্যালয়টিতে কোনো প্রকার অডিট না হওয়ায় তিনি এবং বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি দু’জনে মিলে ৬ বছরেই প্রায় ৪ কোটি টাকা আত্মসাথ করেছেন বলে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। অন্যদিকে প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে রফিকুল আলা অবসর নিলে সুবর্ণা জামান নামে একজন সহকারী শিক্ষককে ৭ দিনের জন্যে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই শিক্ষকের সহযোগিতাতে ৩২ লক্ষ টাকা আর্থিক সুবিধা নিয়ে শেখ আবদুল মান্নান নামে একজনকে নতুন প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন বলে জনশ্রæতি রয়েছে। আবার নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দায়িত্বগ্রহণের ১০ মাসেই বিদ্যালয় ফাণ্ডের ২৪ লক্ষ টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে বিল ভাউচার বানিয়ে তসরুপ করেছেন। বিদ্যালয়টিতে এমনসব তুঘলকি কাণ্ড ঘটে চলায় বিদ্যালয়ের এডহক কমিটির নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি বিশিষ্ট আয়কর উপদেষ্টা মির্জা ওয়ালিদ হোসেন শিপন বিদ্যালয়টিতে সরকারি অডিটের দাবি করেছেন।
বিদ্যালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ২০১২ সাল থেকে এসএসএম রফিকুল আলা প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসলেও ২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত সেখানে আয়-ব্যায়ের কোনো হিসাব নেই। বিদ্যালয়ের ক্যাশবই অনুযায়ী ২০১৮ সালের পর থেকে শিক্ষার্থীদের বেতন, পরীক্ষা ও টিউশন ফিস, ঘরভাড়া এবং অন্যান্য খাত থেকে ৪ কোটি ১৩ লক্ষ ৬৬১ টাকা আয় হলেও দেখানো হয়েছে মাত্র ২ কোটি ৭০ লক্ষ ১০ হাজার ২১৩ টাকা। আবার এ টাকার মধ্যে ১ কোটি ১০ লক্ষ ৪৮ হাজার ৫৮১ টাকা জমা করা হলেও প্রদর্শিত ও অপ্রদর্শিত ৩ কোটি ২ লক্ষ ৮৭ হাজার ৮০ টাকার কোনো হিসাব নেই।
২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ নেতা হুমাউনুর রশীদ মুহিত বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে এক নাগাড়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পদটি আকড়ে রাখেন। ২০১৮ সালের দিকে তিনি বিদ্যালয় ভবনের সাথে ১শত ৮টি দোকানঘর তৈরির উদ্যোগ নেন। যেখানে দোকান প্রতি ৩ লক্ষ টাকা আদায় করা হলেও তার কোনো চুক্তিপত্র পাওয়া যায়নি। এই খাত থেকে ৩ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা আয় হওয়ার কথা থাকলেও ক্যাশ বইতে মাত্র ৯৪ লক্ষ ৫৯ হাজার ৩৫২ টাকা দেখানো হয়েছে।
আবার বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রধান শিক্ষক রফিকুল আলা বিদ্যালয় সভাপতি হুমাউনুর রশীদ মুহিতের টপটেন ভাটার হিসাব নম্বরে ৫১ লক্ষ ট্রান্সফারের পাশাপাশি নিজে অবসরে যাওয়ার তিনটি চেকের মাধ্যমে ২৩ লক্ষ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাথ করেছেন। অন্যদিকে অবসরে যাওয়ার পরের মাসের বিভিন্ন তারিখে বেশ কয়েকটি দোকানের বরাদ্দ দিয়ে সেখান থেকেও মোটা অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে স্কুল মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
এদিকে রফিকুল আলা অবসরে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক মুনীর হোসেনকে। কিন্তু সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা মুহিত কোনো প্রকার কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়াই তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সুবর্ণা জামান নামে একজন সহকারী শিক্ষককে দায়িত্ব দেন। শুধু তাই নয় একই তারিখে নিয়োগ বোর্ড গঠন করে শেখ আবদুল মান্নানকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেন। বিদ্যালয়ের কার্য বিবরনীতে নিয়োগ কমিটির বিষয়ে কিছু উল্লেখ না থাকলেও গত বছরের ৮ এপ্রিল তারিখে প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে বসে গেছেন শেখ আবদুল মান্নান। শুধু তাই নয়, দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম ১০ মাসেই বিদ্যালয় ফাণ্ডের ২৪ লক্ষ ২৪ হাজার ৪৮৩ টাকা ব্যাংকে জমা না করে বিভিন্ন ভাউচারের মাধ্যমে তিনি তসরুপ করেছেন বলে বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরিণ অডিট থেকে জানা গেছে।
তবে বর্তমান প্রধান শিক্ষক শেখ আবদুল মান্নান এ বিষয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, টাকা ব্যাংকে জমা না করা অপরাধ হলেও ওই টাকা বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কাজে ব্যয় করা হয়েছে যার বিল ভাউচার রয়েছে।
বিদ্যালয় তহবিলের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং অনিয়মের বিষয়ে কথা বলতে বিদ্যালয়ের তৎকালিন সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা হুমাউনুর রশীদ মুহিত এবং সাবেক প্রধান শিক্ষক এএসএম রফিকুল আলার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
বিদ্যালয়ের এডহক কমিটির সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হোসেন শিপন বলেন, বিগত সময়ে প্রধান শিক্ষকসহ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি নানা উপায়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাথ করেছেন। নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমেও তারা অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। আর অনৈতিক সুবিধাগ্রহণের মাধ্যমে এসব কাজের সহযোগিতা দিয়েছেন মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের কতিপয় কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে মাগুরা জেলা শিক্ষা অফিসার মো. আলমগীর কবীর অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নিয়োগ এবং বেতন ছাড়ের ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠলেও লিগ্যাল এডভাইজারের আইনী মতামত নিয়েই সেটি সম্পন্ন করা হয়েছে।